Tuesday, July 7, 2015

লাইলাতুল‬ ক্বদর

                                     লাইলাতুল‬ ক্বদর

সূরা দুখানে ৩ ও ৪ নং আয়াতে বলা হয়েছেঃ
رين منذ اناكنا مبركة ليلة فى انزلنه انا
ইন্না-আনযালনা-হু ফী লাইলাতিম্ মুবা-রাকাতিন্ ইন্না-কুন্না মুনযিরীন।(সূরা দুখান- ৩)।
নিশ্চয়ই আমি কোরআন অবতীর্ণ করেছি এক কল্যানময় রজনীতে; আমিতো সতর্ককারী।
امرحكيم كل ق يفر فيها
ফীহা- ইউফ্ারকু কুল্লু আম্রিন হাকীম। (সূরা দুখান আয়াত ৪)।
এ রজনীতে প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরীকৃত হয়-
৩ নং আয়াতের টিকাঃ বরকত পূর্ণ রাত্রি দ্বারা এখানে রমাযান মাসের লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রি বলে উল্লেখ করা হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস, ইবনে উমর, মুজাহিদ, কাত্বাদাহ, হাসান বসরী, ইবনে যুবাইর, ইবনে যায়েদ, দহহাক ও অন্যান্য প্রখ্যাত তাফসিরকারক গণের অভিমত। তবে কেউ কেউ শাবান মাসের অর্ধেক অর্থাৎ শবে বরাতকে লাইলাতুল মুবারক বলেছেন। এটা নির্ভরযোগ্য হাদীস দ্বারা সাবিত হয় নাই। বরং ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, সারা বৎসরের যাবতীয় কার্যাবলী, রিযিক, আয়ু,মৃত্যু, বৃষ্টি সবকিছু লাইলাতুল ক্বদরে লাওহে মাহফুজ থেকে স্থানান্তরিত হয়। (দুররে মনসুর)।
হাফেয ইবনে কাছির (৭০১-৭৭৪ হিঃ) স্বীয় তাফসীরে উল্লেখ করেছেন, ‘এখানে মুবারক রজনী অর্থ লাইলাতুল ক্বদর’। যেমন সূরা ক্বদরের ১নং আয়াতে এসেছে ‘ইন্না-আন্যাল্না হু ফী লাইলাতিল্ ক্বাদ্রি’ অর্থঃ আমি এই কুরআন নাযিল করেছি মহিমান্বিত এক রাতে।
আর নাযিল হয়েছে রমাযান মাসে আর এ ব্যাপারে সূরা বাক্বারাহর ১৮৫ নং আয়াতে আল্লাহ বলেনঃ شهررمضا
والفرقان الهدى من وبينت للناس هدى القران فيه اذزل الذي ن
“এই সেই রমাযান মাস যার মধ্যে কুর’আন অবতীর্ণ হয়েছে”।
এ সকল আয়াতেরই ভিন্ন রূপ ব্যাখ্যা আর কিছু হাদীস ‘মুরসাল’ ও ‘যঈফ’ দ্বারা শবে বরাতের রাত সাব্যস্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে যা সম্পূর্ণ কোরান ও সহীহ হাদীসের বিরুদ্ধ এবং অগ্রহনযোগ্য। দুররে মনসুর-এ এসেছে ও হাফেজ ইবনে কাছির বলেন, ক্বদরের রজনীতেই লাওহে মাহফুযে সংরক্ষিত ভাগ্যলিপি হতে পৃথক করে আগামী এক বছরের নির্দেশাবলী তথা মৃত্যু, রিযিক ও অন্যান্য ঘটনাবলি যা সংঘটিত হবে, সেগুলো লেখক ফেরেশতাদের নিকট প্রদান করা হবে। এখানে নতুনভাবে কোন কিছু নির্ধারিত হবে না, যা লাওহে মাহফুযে লিপিবদ্ধ আছে সেটাই আগামী এক বছরের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ফেরেশতাদের নিকট পৌঁছে দেওয়া হবে।
‘তাকদীর’ নতুন করে কিছূ লেখা হবে না। কারণ এ ব্যাপারে আল্লাহ কোরআনে বলেছেনঃ مستطر صغيروكبير وكل الزبر فى فعلوه شىء وكل
“তাদের সমস্ত কার্যকলাপ আছে আমল নামায়, আছে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ সমস্ত কিছু লিপিবদ্ধ। (সূরা ক্বামার ৫২-৫৩)।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আসমান সমূহ ও যমীন সৃষ্টির পঞ্চাশ হাজার বছর পূর্বেই আল্লাহ তাআলা স্বীয় মাখলু ক্বাতের তাক্বদীর লিখে রেখেছেন, তিনি আরো বলেন (সেই সময়) আল্লাহর আরশ পানির উপর ছিল। (মুসলিম হা/২৬৫৩)।
এবং আবূ হুরায়রা (রাঃ)-কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘তোমার ভাগ্যে যা আছে তা ঘটবে; এ বিষয়ে কলম শুকিয়ে গেছে।
লাইলাতুল ক্বদরের রাত্রেই ফিরিশতাগণ ও রুহ অবতীর্ণ হয় এদের প্রতিপালকের অনুমতি ক্রমে। যা সূরা ক্বদরের ৪ ও ৫ নং আয়াতে বলা হয়েছে। ৪। ○ مر ا كل من ربهم باذن فيها والروح الملﺉكة تنذل তানাযযালালুল মালা-ইকাতু ওয়াররুহু ফীহা-বিইযনী রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমরিন। ৫। ○ الفج مطلع هىحتى سلم সালা-মুন হিয়া হাত্তা মাত্বলা’ইল ফাজ্বরি। অর্থঃ সে রাতে ফেরেশতাগণ ও জিব্রাইল অবতীর্ণ হয় তাদের প্রতিপালকের অনুমতিক্রমে প্রত্যেক কল্যানকর বিষয় নিয়ে। ফজরের উদয় পর্যন্ত সে শান্তিময় নিরাপদ থাকে।
###‪#‎আমাদের‬ দেশে অনেক গ্রন্থ পাওয়া যায় সূরা ক্বদরের ব্যাখ্যার বাংলা অনুবাদে লেখা হয়ে ‘রুহু সমূহ’ আর এটাই বুঝানো হয় সকল মৃত ব্যক্তির রুহু এই দুনিয়ায় নেমে আসে। এটা বানোয়াট মিথ্যা। এ রকম অর্থ কোন প্রকৃত কোরান, হাদীস বিশারদগণ করেননি। ‘রুহু’ শব্দটি এক বচন। যেমন পূর্বোক্ত সূরা ক্বদরের ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে। এ সম্পর্কে হাফেয ইবনে কাছীর (রহঃ) স্বীয় তাফসীরে বলেন, এখানে রুহ বলতে ফিরিশতাগণের সরদার জিব্রাইলকে বুঝানো হয়েছে। হযরত আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, যখন লাইলাতুল ক্বদর আরম্ভ হয় তখন জিব্রাইল (আঃ) ফেরেশতার দলসহ অবতীর্ণ হন।
(বায়হাক্বী, বঙ্গানুবাদ মিশকাত হা/১৯৮৯)।
*****রমাযান মাসের প্রতিটি দিন ও রাত একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। পুরো রমাযান মাসই রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের মাস। এ মাসে জান্নাত ও রহমতের দরজা সমূহ খুলে দেওয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করা হয়।(মুত্তাফাক আলাইহী, মিশকাত হা/১৯৫৬)।
এ মাসে বহু লোক জাহান্নাম থেকে মুক্তিপ্রাপ্ত হয়।(তিরমিযী, ইবনে মাজাহ,মিশকাত হা/১৯৬০)।
তবে শেষ দশকের রাতগুলো অধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যপারে সহীহ হাদীস ও কোরআনে এসেছে শেষ দশকে, রমাযান মাসে কোরআন নাযিল হয়েছে।(সূরা বাক্বারাহ ১৮৫)।
এ রাত মহিমান্বিত রাত,এই মহিমান্বিত রাতটি সহস্র মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। (সূরা ক্বদর ৩)।
###‪#‎আয়েশা‬ (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) রমযানের শেষ দশকে ইতেকাফ করতেন এবং বলতেনঃ রমযানের শেষ দশকে শবে ক্বদরের অনুসন্ধান কর।
(বুখারী হা/ ২০২০ ও মুসলিম ১১৬৯)।
এ হাদীসে রাসূলুল্লাহ(ছাঃ)স্পষ্ট রমযানের শেষ দশকে শবে ক্বদরের অনুসন্ধান করতে বলেছেন। (পাঠক আপনারা যারা মসজিদে নববীর খোজ খবর রাখতে পারেন বা পারার সুযোগ রাখেন আমাদের দেশের যারা সৌদী চাকুরী করে তাদের কাছে জানতে পারবেন) মসজিদে নববীতে বিভিন্ন দেশ থেকে ইতেকাফের উদ্দেশ্যে মুসলমানেরা যায় এবং অবস্থান করেন। তারা রমযানের শেষ দশকের প্রত্যেক রাতগুলোতে শবে কদরের অনুসন্ধানে মগ্ন হন। সেই সঙ্গে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন। আল্লাহর অনুগ্রহ পেতে কান্নাকাটি করতে থাকে। উদ্দেশ্য ক্ষমা পাওয়া এবং ঐ সহস্র মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ রজনীকে নিজেদের ইবাদতের মধ্যে শামীল করা।
নাবী (ছাঃ) বলেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সহিত ও সওয়াবের নিয়তে শবে ক্বদরে কিয়াম করে তার পূর্বের গুনাহ সমূহ ক্ষমা করে দেয়া হবে।
(বুখারী হা/১৯০১)।
এ সকল হাদীসে স্পষ্ট যে, বান্দা দাড়িয়ে বসে সর্ব অবস্থায় লাইলাতুল ক্বদরের রাতে ইবাদত বন্দেগীতে লিপ্ত থাকা অবস্থায় আল্লাহর তার প্রতি দোয়া করতে থাকে। এ রাতে বেশী বেশী নফল সালাত, তিলাওয়াত, যিকর ইত্যাদি যে কোন ইবাদত করা যায়। এবং আল্লাহ তার প্রতিদান সহ গুনাহ সমূহ মাফ করে দেন।
বর্তমানে রাত্রি জাগরনের জন্যে মসজিদে সকলে সমবেত হয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের যে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সেটিও নবাবিস্কৃত কাজ। কারণ আল্লাহর নবী -(ছাঃ)তাঁর সময়ে সাহাবীদের নিয়ে মসজিদে জাগরিত হয়ে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইবাদত না করে নিজ নিজ পরিবারকে জাগিয়ে কিয়ামুল লাইল পালন করতেন।
( বূখারী হা/২০২৪;২/৩৫১পৃঃ; টিকা তাওহীদ প্রকাশনি পৃঃ ২/৩৫০)
#####‪#‎এই‬ রাতটি কবে এবং আমাদের করণীয়ঃ
বর্ণনায় (হাদীসে) এসেছে, ‘রমাযান মাসের প্রথম অংশ রহমত, মধ্যম অংশ মাগফেরাত ও শেষ অংশ জাহান্নাম থেকে মুক্তির’। এই হাদীসটি যঈফ, মুনকার। (“কিতাবুদ দুয়াফা” লিল উকাইলী ২/১৬২ পৃষ্ঠা, “আল কামেল ফি দুয়াফায়ির রিজাল” লি ইবনে আদি ১/১৬৫, “কিতাবু ইলালিল হাদীছ” লি ইবনে আবী হাতেম ১/২৪৯, “সিলসিলাতিস আহদিসুস দায়িফা ওয়াল মওদুয়াহ” লিল আলবানী ২/২৬২ ও ৪/৭০)।
হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) হতেও উক্ত মর্মে বায়হাক্বী, ইবনে খুযায়ামা হা/১৮৮৭ ও মিশকাত হা/১৯৬৫০-তে বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটির সনদ যঈফ ও মুনকার। (যঈফ আত-তাগরীব হা/৫৮৯, মিশকাত হা/১৯৬৫, আলবানী)।
#####‪#‎এখন‬ প্রশ্ন হচ্ছে মহিমান্বিত রাতটি কবেঃ
কোরান বলছে রাতটি রমাযান মাসে, হাদীসে বলছে রমযানের শেষ দশকের রাতে, অর্থাৎ রমাযান মাসের শেষ দশরমযানে,(বূখারীহা/২০২০) বিভিন্ন সহীহ হাদীসের বর্ণনায় ২১,২৩, ২৫,২৭,২৯,রাতের কথা উল্লেখ আছে।
অন্য হাদীসে এসেছেঃ ইবনে উমার (রাঃ) বলেন, নবী করীম (ছাঃ) এর
সাহাবী গণের কয়েকজনকে স্বপ্নে দেখানো হল, লাইলাতুল ক্বদর (রমযানের) শেষের সাত রাত্রের মধ্যে। রাসূলুল্লাহ(ছাঃ) বললেন,আমি দেখছি তোমাদের সকলের স্বপ্নই একইরূপ শেষে সাত রাত্রিতে সীমাবদ্ধ। সুতরাং যে তা অন্বেষন করে সে যেন শেষ সাত রাত্রিতে অন্বেষন করে।
(বুখারী হা/২০২১; মিশকাত হা/২০৮৪)।
ইবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, ‘তোমরা তালাশ করবে তা (লাইলাতুল ক্বদর) রমযানের শেষ দশকে মাসের ৯ দিন বাকী থাকতে,৭ দিন বাকী থাকতে, ৫ দিন বাকী থাকতে। (বুখারীর হা/২০২২; মিশকাত হা/২০৮৫)।
*****এক শ্রেণীর আলেম বলেন, লাইলাতুল ক্বদর নিয়ে অনেক মতভেদ থাকলেও প্রবল মত ২৭ রমযানের রাত-ই লাইলাতুল ক্বদর। সে হিসাবে এই রাতকে প্রাধান্য দিয়ে মসজিদে মুছল্লীদের ঢল নামে। এবং ঐ সব আলেমরা কেবল এই একটি রাতেই ইবাদত করার প্রচার করে বিশেষ ভাবে সালাত আদায় ও কুরআন তেলাওয়াতের নির্দেশ দেয়। এবং এই মত অনুযায়ী ২৭শে রমযানের পরের দিন সরকারী ছুটিও ঘোষনা করা হয়। এ মতের যে সকল হাদীসের দলীল পেশ হয় তা হল রাসূল (ছাঃ) বলেন, তোমরা রমযানের শেষ ১০ রাতে লাইলাতুল ক্বদর অন্বেষণ কর। যদি তোমাদের কেউ দুর্বল অক্ষম হয় তাহলে সে যেন ২৭ তারিখ রাতে ইবাদত করে। (মুসলিম হা/১১৬৫)।
উবাই ইবনে কাব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদুর জানি রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে লাইলাতুল ক্বদর জ্ঞান করে যে রাতে দাঁড়িয়ে থাকতে বলেছেন, তা হচ্ছে রমযানের ২৭তম রাত। তিরমিযী শরীফে এসেছে তাবেঈ হযরত মুনযির (রঃ) হতে উবাই ইবনে কা’ব থেকে বর্ণনা করেছেন। উক্ত হাদীসে ইবনে মাস’উদ (রাঃ) এর কথাও এসেছে। কিন্তু তা তিনি পছন্দ করেননি, মুসলমানেরা ঐ একটি রাতের উপর ভরসা করুক সেই কারণে--- (তিরমিযী বঙ্গানুবাদ তিরমিযী পৃষ্ঠা নং-২১২, সোঃ প্রকাশ)।
অন্য একটি হাদীসে ইবনে মাসউদ ,রাসূল (ছাঃ) - কে তিনি নিজে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে, তাকে তেইশ রাতে আসতে বলেন।
*****মূল কথা রাসূল (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা শেষ দশকে রমাযান মাসে লাইলাতুল ক্বদর তালাশ কর। ইতিপূর্বে মসজিদে নববীর ইবাদতের কথা উল্লেখ করেছি। লাইলাতুল ক্বদর রাতকে আমাদের সেভাবেই তালাশ করা উচিৎ। যাতে করে ঐ দশ দিনের মধ্যে আমরা হাজার মাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই রাতটি পায় এবং আমাদের ইবাদতকে ঐ রাতে শামীল করে গুনাহ সমূহ মাফ করে নিতে পারি। আমরা মতের উপর ভরসা করে ঐ মহিমান্বিত রাতটি যেন না হারায়। এ ব্যাপারে সতর্ক হওয়া উচিত দুঃখের বিষয় কিন্তু আমরা তা না করে সওয়াবের আশায় নতুন নতুন ইবাদত সৃষ্টি করছি যেমনটি শবে বরাত, ‘ভাগ্যরজনী’ নামক।

No comments:

Post a Comment