Saturday, June 6, 2015

আত্মিক উন্নয়নে কুর’আনের ভুমিকা


আত্মিক উন্নয়নে কুর’আনের ভুমিকা :

লেখকঃ মনসূর আহমেদ | অনুবাদকঃ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ

===============================================

“সত্যিকার অর্থে পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হলে আমাদের প্রতিপালকের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আমরা কখনই বাড়াবাড়ি করতাম না; কুর’আন না পড়ে একটি দিনও কাটুক এমনটি ভাবতেই আমার ঘৃণা হয়।”

তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বর্তমান সময়ে একটি অনেক বড় সমস্যা যা মুসলিম উম্মাহ্‌কে চরমভাবে ভুগাচ্ছে। অথচ বিষয়গুলো নিয়ে কোন সমস্যা হবার কথা ছিলনা। এহেন পরিস্থিতি ভবিষ্যতে আরো জটিল পরিস্থিতিরই এক পূর্বাভাস দেয়। আর এসব অনর্থের মুলে হল আমাদের আত্মিক পরিশুদ্ধতার দেউলিয়ত্ব। বিশেষ করে ঈমান সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কেউ বিতর্কে লিপ্ত হলে বুঝতে হবে এটা তার একটা আত্মিক ব্যাধি যা তাকে খামাখা বিতর্কে লিপ্ত করে রাখে। এতে করে ব্যক্তি তার প্রতিপক্ষকে ভুল প্রমাণের মাধ্যমে এক অকৃত্রিম আত্মতৃপ্তি লাভ করে; প্রতিপক্ষকে যুক্তির বাণে ঘায়েল করে নিজের পাশবিক আকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করে। এমন ধরনের তর্ক-বিতর্ককে শয়তান মানুষের সম্মুখে আরো সৌন্দর্যমন্ডিত করে তোলে ফলে একজন মনে করে অন্যজন ভুল পথে আছে আর সে তাকে সঠিক পথে নিয়ে আসার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে অনেক মহান একটি কাজ করছে।

এহেন আচরণ পারস্পারিক অবজ্ঞা আর মানসিক বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করে। ফলে মানুষে মানুষে মতানৈক্য সৃষ্টি হয়। অথচ কুর’আনের শিক্ষা হল এমন আচরণের সম্পূর্ণ বিপরীত। আসল কথা হল কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতির কারনেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে; আর কুর’আনও ঠিক একই কথা বলে। কুর’আন আল-কারীমে আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ

“হে মানব জাতি! তোমাদের কাছে তোমাদের প্রতিপালকের তরফ হতে সমাগত হয়েছে এক নসিহত এবং অন্তরসমূহের সকল রোগের আরোগ্যকারী, আর মু’মিনদের জন্যে পথ প্রদর্শক ও রহমত।” [সূরা ইউনুস; ১০:৫৭]

আমাদের আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য কুর’আন না মেনে কোন উপায় নেই; কুর’আনই আমাদেরকে বারবার মনে করিয়ে দেয় এই বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীন; কুর’আনের মাধ্যমেই আমরা এই পার্থিব জীবনের নশ্বরতা, আমাদের শেষ পরিণতি তথা মৃত্যু তারপর পুনরুত্থান, বিচার দিবস, জান্নাত ও জাহান্নামের ইত্যাদির কথা স্মরণ করে থাকি। এই কুর’আন আমাদের জীবনের প্রতিটি বিষয়কে করে রেখেছে সুসংহত এবং সুসমন্বিত। যা একজন মু’মিনের জন্য আল্লাহ্‌র পক্ষ থেকে আসা অনুগ্রহ শুধুই অনুগ্রহ। অনুগ্রহ মু’মিনের জন্য কখনো অভিশাপ হয়ে আসতে পারে না। এজন্য খলীফা উসমান ইবনে আফফান (রা) বলেনঃ

“সত্যিকার অর্থে পরিশুদ্ধ হৃদয়ের অধিকারী হলে আমাদের প্রতিপালকের সিদ্ধান্তকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে আমরা কখনই বাড়াবাড়ি করতাম না; কুর’আন না পড়ে একটি দিনও কাটুক এমনটি ভাবতেই আমার ঘৃণা হয়।”

কাজেই দেখা যাচ্ছে, আমাদের উচিৎ জীবনের প্রতিটি পরতেই কুর’আনকে আঁকড়ে ধারণ করা এবং এমনসব কুতর্ক এড়িয়ে চলা যা কোনভাবেই আমাদের জন্যে কোন প্রকারের কল্যাণ বয়ে আনেনা। প্রকৃতঅর্থেই, কুর’আন হল আমাদের “আত্মার খোরাক”-এটা আমাদের আত্মার পুষ্টি সাধন করে থাকে; আমাদের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে এবং সর্বোপরি, এটা আমাদের পারলৌকিক জীবনের সাথে সেতু বন্ধন তৈরি করে। পৃথিবীর মাটি থেকেই আমাদের দেহ সৃষ্ট আর এ পৃথিবীতেই আল্লাহ্‌ আমাদের বেঁচে থাকার উপাদান মজুত রেখেছেন। যা কিছুই আমরা খাই তা কোনো না কোনোভাবে মাটি থেকেই উৎপন্ন। আমাদের আত্মা এসেছে আল্লাহ্‌র নিকট থেকে, তাই এর বেঁচে থাকার উপাদান আল্লাহ্‌ পাঠিয়েছেন রূহের জগত থেকে। এজন্য কুর’আনের সংস্পর্শে হৃদয় প্রশান্তি লাভ করে। পক্ষান্তরে, কুর’আন থেকে দূরে সরে গেলে আমাদের হৃদয় তথা আত্মার অপমৃত্যু ঘটে।

আল্লামা হাফিজ ইবনুল কায়্যিম (রহিমাহুল্লাহ্‌) বলেনঃ

“কুর’আন মেনে চলা, আল্লাহ্‌র প্রতি নিভৃতেও বিনয়ী হওয়া ও পাপ পরিত্যাগ করার উপর নির্ভর করে হৃদয়ের বেঁচে থাকা।”

খাদ্যের অভাবে শরীর যেমন উপোস থাকে ঠিক তেমনি করে কুর’আন থেকে দূরে সরে গেলে মানুষের আত্মাও অভুক্ত থাকে; ফলে জীবন হয়ে ওঠে এক দুঃসহ যন্ত্রণার আঁধার। আর এভাবেই আত্মা তখন তর্ক-বিতর্কের মাঝে তার খোরাক খুঁজে পেতে চেষ্টা করে।

কুর’আনের নির্দেশনাকে গুরুত্ব না দেয়া, কুর’আনের হুকুম মেনে না চলা, কুর’আনকে হেদায়াতের উৎস হিসেবে বিবেচনা না করা, আত্মিক উন্নতি এবং হৃদয়ের অসুখ সারানোর জন্যে কুর’আনকে নিরাময় হিসেবে গ্রহণ না করা ইত্যাদি সবই হল কুর’আন পরিত্যাগ করার সমতুল্য। আল্লামা হাফিজ ইবনুল কায়্যুম (রহিমাহুল্লাহ্‌) এর মতে, উল্লেখিত বিষয়গুলোর সবকটিই নিম্নোক্ত আয়াত দ্বারা স্পষ্ট যেখানে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আলামীন বলেনঃ

“রাসূল (সা) বললেনঃ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কুর’আনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।” [সূরা আল-ফুরকান; ২৫:৩০]

আমরা লক্ষ্য করলে দেখি যে, কুর’আনের যেখানেই কোন কিছু করার জন্যে নির্দেশ দেয়া হয়েছে সেখানেই উল্লেখ করা হয়েছে আল্লাহ্‌ভীতির কথা না হয় জান্নাত-জাহান্নামের কথা। তবে যা করতে বলা হয়েছে তা করাটাই যথেষ্ট নয়। বিধিনিষেধ মেনে চলার বিষয়গুলো আসলে আধ্যাত্মিকতা এবং আন্তরিকতার সাথে সংশ্লিষ্ট। আন্তরিকতা বিবর্জিত সৎকর্মের ফলাফল শূন্য। আন্তরিকতার সাথে সৎকর্ম সম্পাদন করার মাধ্যমেই নিজের ভেতর কুর’আনের শিক্ষা বিকশিত হতে থাকে। কুর’আনের বিধিনিষেধ মেনে চলার মাধ্যমেই তৈরি হয় স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ক। স্রষ্টার সাথে সম্পর্কের উন্নয়নের মাধ্যমেই মানুষ উপলব্ধি করতে সক্ষম হয় ইবাদতের তাৎপর্য তথা আল্লাহ্‌ রাব্বুল ‘আলামীনের হুকুম মেনে চলার নিহিতার্থ এবং ভ্রাতৃত্বপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণের গুরুত্ব। তাই ব্যক্তির তর্কে লিপ্ত হওয়া এটাই প্রমান করে যে, সে তার স্রষ্টার ইবাদতের ব্যপারে কতটা উদাসীন এবং আন্তরিকতা বিবর্জিত। অথচ স্রষ্টার ইবাদতের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল মানুষকে কুর’আনের শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করে বিতর্ক করা থেকে দূরে রাখা।

কুর’আন প্রতিনিয়তই আমাদেরকে মানব জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মনে করিয়ে দিতে থাকে এবং সকলের এক ও অভিন্ন লক্ষ্যের সাথে আমাদের কর্মকাণ্ডকে জুড়ে দেয়। আর সেই এক ও অভিন্ন লক্ষ্য হল চিরস্থায়ী সুখের আবাস জান্নাত অর্জন এবং অনন্ত শাস্তির আবাস জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ। আকীদাহ্‌গত এবং ফক্‌হী কিছু বিষয় আছে যেগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তবে সেগুলো কখনই আমাদের পারস্পারিক সম্পর্ককে যাতে বিনষ্ট করে না দেয় সেজন্য আমাদের যত্নবান হওয়া উচিৎ।

No comments:

Post a Comment