ইমাম আবু হানীফা (রা) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
নাম, উপনাম ও বংশ: নাম নু’মান, উপনাম আবু হানীফা।
বংশনামা: “নুমান বিন সাবিত বিন যুত্বাই আল খায্যায আল কুফী।
তিনি কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই আল খাযযায বলে পরিচিত এবং তিনি কুফা নগরীতে জন্মলাভ করেছেন এবং সেখানে জীবন-যাপন করেছেন এজন্য আল-কুফী বলে পরিচিত। বংশগতভাবে তিনি আত-তাইম, অর্থ্যাত তাঁর দাদা “যূত্বাই” রাবীয়া বংশের উপগোত্র বনী তাইমিল্লাহ বিন ছা’লাবার অধিনস্ত ছিলেন, এ সূত্রেই তিনি বংশগতভাবে আত-তাইমী বলে পরিচিত।
জন্ম ও প্রতিপালন: বিশুদ্ধ মতে ইমাম আবু হানীফা (রহ) কুফা নগরীতে ৮০ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুফা নগরীতে প্রতিপালিত হন এবং জীবনের শুরুতেই কাপড়ের ব্যবসায় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সততার সাতে ব্যবসায় পরিচালনা করায় তিন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
শিক্ষা জীবন: ইমাম আবু হানীফা (রহ) জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী কর্মে আত্মনিয়োগ করেন, শিক্ষা দিক্ষায় মনোনিবেশ হননি। ইমাম শা’আবী (রহ) এর সাথে সাক্ষাত ঘটলে তাঁর পরামর্শে তিনি শিক্ষামুখী হন। ইমাম আবু হানীফা নিজেই বলেন, আমি একদিন ইমাম শা’আবীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম , তখন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, তুমি কার কাছে যাচ্ছ ? আমি তাকে উস্তায সম্বোধন করে বললাম যে, আমি বাজারে যাচ্ছি। ইমাম শা’আবী (রহ) বললেন, তোমার বাজারে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করিনি, আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন আলিমের কাছে যাচ্ছ ? জবাবে ইমাম আবু হানীফা (রহ) বললেন, “আসলে আলিমদের সাতে আমার যোগাযোগ খুবই কম।‘ ইমাম শা’আবী (রহ) বললেন, না তুমি এরুপ করো না, বরং তুমি শিক্ষামুখী হও এবং আলিমদের সাথে উঠাবসা শুরু কর, কারণ আমি তোমার মাঝে ভালো আলামত দেখছি। ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেন, ইমাম শা’আবী’র এই উপদেশ আমার হৃদয়ে রেখাপাত করলো ফলে আমি বাজার যাওয়া বন্ধ করলাম এবং জ্ঞান গবেষণামুখী হলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপদেশের মাধ্যমে আমাকে উপকৃত করেছেন।
এভাবেই আবু হানীফা (রহ) শিক্ষা জীবন শুরু করেন। শিক্ষা জীবন শুরু করে তিনি কালাম শাস্ত্র ও তর্কবিদ্যা শিক্ষালাভ করে ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদে তর্ক সংগ্রাম চালিয়ে তার্কিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু এ তর্ক চর্চা কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের বিঘ্নতা সৃষ্টি করলে তর্ক চর্চ্চা বর্জন করে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ চর্চ্চায় মনোনিবেশ করেন।
ইমাম আবূ হানীফার (রহ) শিক্ষকবৃন্দ:
ইমাম আবু হানীফা (রহ) কোন সাহাবীর দেখা সাক্ষাত পেয়েছেন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তিনি ছোট বয়সে দু’একজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেন বলে জীবন লেখকরা উল্লেখ করেছেন যেমন আনাস বিন মালিক (রা) কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি, কারণ তিনি প্রাথমিক যুগে ব্যবসায়ী কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, অত:পর ইমাম শাআবী’র অনুপ্রেরণায় দ্বীন শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আল মিযযী (রহ) ইমাম আবু হানীফা (রহ) যাদের কাছে শিক্ষালাভ করেছেন তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোট ৫০ জন শাইখ এর নাম উল্লেখ করেন।
তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো:
1. যায়িদ বিন আলী আল হাশেমী (রহ)
2. আদী বিন ছাবিহত আল-আনসারী (রহ)
3. আবদুল মালিক বিন আবিল মাখারিক আল মাসরী (রহ)
4. মুহাম্মাদ বিন আলী আল হাশেমী (রহ)
5. আবদুল মালিক বিন আবিল মাখারিক আল-মাসরী (রহ)
6. হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমান আল-আশয়ারী (রহ)
ইমাম আবু হানীফার (রহ) ছাত্রবৃন্দ:
1. জারীর বিন আব্দুল হামীদ আল কুফী (রহ)
2. হাম্মাদ বিন আবী হানীফাহ আল কুফী (রহ)
3. ইমাম আবদুল্লাহ বিন মুবারক আল হানযালী (রহ)
4. ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান আশশায়বানী (রহ)
5. ইমাম ইয়াকুব বিন ইবরাহীম আবূ ইউসূফ আল কাযী (রহ)
6. ইমাম নূহ বিন আবী মারয়াম আল মারওয়াযী (রহ) প্রমুখ।
ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ):
ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ)- এর অবস্থান ও অবদান সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখেনা, কারণ তিনি ফিকাহ শাস্ত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইমাম সাহেবের অন্যতম ছাত্র ইমাম আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক (রহ) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহ) স্বীয় যুগে ফিকহ শাস্ত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বি ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সমযুগে প্রসিদ্ধ তাবেঈ যেমন আত্বা বিন রাবাহ, নাফি, মাওলা ইবনু উমার ও কাতাদাহ প্রভৃতি তাবেঈদের (রহ) হতে ফিকহ শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তবে ফিকহ শাস্ত্রের উপর ইমাম সাহেবের উল্লেখযোগ্য কোন রচিত গ্রন্থ পাওয়া যায় না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ):
ইমাম আবু হানীফা (রহ) একশত হিজরীর পরে অর্থ্যাত তাঁর বিছর বছর বয়সের পর তিনি হাদীস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং অনেক প্রসিদ্ধ আলিম হতে শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা খুবই নগণ্য।
এর দুটি কারণ হতে পারে:
প্রথম কারণ: তিনি হাদীস বর্ণনায় কঠোরতা অবলম্বন করতেন। ইমাম ইবনু সালাহ (রহ) বলেন:
“হাদীস বর্ণনায একশ্রেণীর মানুষ কঠোরতা অবলম্বন করে সীমালঙ্ঘন করেছেন, আবার আরেক শ্রেণী শিথিলতা অবলম্বন করে সীমালঙ্ঘন করেছেন। কঠোরতার মধ্যে হলো, যারা মনে করেন যে, বর্ণনাকারীর শুধু মুখস্ত বর্ণিত হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না, ইহা মালিক ও ইমাম আবু হানীফার মত।
দ্বিতীয় কারণ:
ইমামের হাদীস বর্ণনা কম হওয়ার অপর কারণ হলো তিনি মাসআল-মাসায়েলের গবেষণায় বেশী ব্যস্ত থাকতেন। হাদীস বর্ণনার সুযোগ হত না।
উকূদুল জিমান গ্রন্থের লেখক বলেন,
‘ইমাম সাহেবের বিভিন্ন দলীলের মাসআলার গবেষণায় ব্যস্ততার দরুন হাদীস বর্ণনা কমে গেছে, যেমন-প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু বাকর, উমার(রা) সহ অনেকেই প্রচুর জানা-শুনা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ততার দরুন হাদীস বর্ণনা করতে পারেন নি।
ইমাম আবু হানীফার গ্রন্থ:
ঈমাম আবু হানীফার রচিত তেমন কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদগণ কিছূ গ্রন্থ তাঁর রচিত গ্রন্থ বলে প্রসিদ্ধ। এগুলোর মধ্যে আল ফিক্বহুল আকবার, মুসনাদে আবী হানীফাহ,ক্বিতাবুল রাদ আলাল ক্বাদরীয়া,কিতাবুল ওসিয়ত,রিসালাতুল ইমাম আবী হানীফা, আল-আলেম ওয়াল মুতা’আল্লিম প্রভৃতি।
কোন কোন মুহাদ্দিস বলেছেন ওগুলো ইমাম সাহেবের সংকলন নয় বরং তাঁর অনেক পরি সেগুলি সংকলন করে তাঁর নামে দেয়া হয়েছে। আল্লামা শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী হানাফী (রহ) বলেন, বরং সে গ্রন্থগুলো অনেক পরে বিভিন্নজন সংকলন করেন।
ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ) বলেন, অনুরুপ মুসনাদ আবী হানীফাহ ধারণা করা হয ইমাম আবু হানীফার সংকলন, আসলে তা নয়।
অতএব বলা যেতে পারে যে, ইমাম আবু হানীফার (রহ) নামে যে গ্রন্থগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলি হয়তোবা ইমাম আবু হানীফা হতে তাঁর ছাত্ররা শিক্ষালাভের পর যে হাদীসগুলি সংকলন করে তাঁর নামে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।
কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে ইমাম আবু হানীফার তাগিদ:
ইমাম আবু হানীফা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ নিজেও করেছেন সেই সাথে আমাদেরকেও কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেন,
‘কোন বিষয়ে যখন সহীহ হাদীস পাওয়া যাবে, জেনে রেখ সেটাই আমার মাযহাব বা মত ও পথ।
‘ আমি যদি এমন কথা বলি যা আল্লাহ তা’আলার কিতাব ও রাসূলের হাদীসের বিপরীত হয়, তখন আমার কথাকে বর্জন কর।
‘যে ব্যক্তি আমার দলীল অবগত নয়, তার পক্ষে আমার কথা অনুযায়ী ফাতওয়া দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
তিনি স্বীয় শিষ্য ইয়াকুব ইমাম আবূ ইউসূফকে বলেন, সাবধান তুমি আমার কাছে যা কিছুই শুনো, সবই লিখ না, কারণ আমি আজ এক সিদ্ধান্ত দেই, আবার আগামীকাল তা প্রত্যাখ্যান করি। আবার আগামীকাল এক ফাতওয়া বা সিদ্ধান্ত নেই, তার পরের দিন তা প্রত্যাখ্যান করি।
ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে আলিম সমাজের উক্তি:
ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় অনেকেই প্রশংসা করেছেন,
যেমন-
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ) বলেন, ইমাম সাহেব শিক্ষা, আল্লাহভীরুতা ও আখিরাতমুখী হিসেবে এক বিশেষ অবস্থানে ছিলেন। আবু জাফর আল মানসুরের কাজী বা ব্চিারকের পদ গ্রহণের জন্য তাঁকে প্রহার করা হয়েছে তবুও তিনি তা গ্রহণ করেন নি। আল্লাহ তাকে বিশেষ রহম করুন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) বলেন, যদিও মানুষেরা ইমাম আবু হানীফার কিছু বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন এবং অপছন্দ করেছেন,কিন্তু তারঁ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিতে কারো কোনরুপ সন্দেহ নেই।
ইমাম যাহাবী (রহ) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহ) একজন বিশিষ্ট আলিম, গবেষক,সাধক ও ইমাম ছিলেন। তিনি বড় ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী ছিলেন, রাজ-বাদশাহদের কোন পুরষ্কার গ্রহণ করতেন না।
ইমামের মৃত্যুবরণ: মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইমাম আবু হানীফা (রহ) ১৫ই শাবান ১৫০ হিজরী,৭০ বছর বয়স পরপারে পাড়ি জমান এবং বাগদাদের গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন । আমীন!
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
জীবনী সংক্রান্ত তথ্যগুলো সুন্নাতে রাসুল (সা) ও চার ইমামের অবস্থান, সিফাতু সালাতিন নাবী (শায়খ আলবানী
রচিত),সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, সীরাতে নোমান, হানাফী ফিকহের বৈশিস্ট্য প্রভৃতি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
নাম, উপনাম ও বংশ: নাম নু’মান, উপনাম আবু হানীফা।
বংশনামা: “নুমান বিন সাবিত বিন যুত্বাই আল খায্যায আল কুফী।
তিনি কাপড়ের ব্যবসায়ী ছিলেন, তাই আল খাযযায বলে পরিচিত এবং তিনি কুফা নগরীতে জন্মলাভ করেছেন এবং সেখানে জীবন-যাপন করেছেন এজন্য আল-কুফী বলে পরিচিত। বংশগতভাবে তিনি আত-তাইম, অর্থ্যাত তাঁর দাদা “যূত্বাই” রাবীয়া বংশের উপগোত্র বনী তাইমিল্লাহ বিন ছা’লাবার অধিনস্ত ছিলেন, এ সূত্রেই তিনি বংশগতভাবে আত-তাইমী বলে পরিচিত।
জন্ম ও প্রতিপালন: বিশুদ্ধ মতে ইমাম আবু হানীফা (রহ) কুফা নগরীতে ৮০ হিজরী সনে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কুফা নগরীতে প্রতিপালিত হন এবং জীবনের শুরুতেই কাপড়ের ব্যবসায় পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন এবং সততার সাতে ব্যবসায় পরিচালনা করায় তিন জনপ্রিয়তা অর্জন করেন।
শিক্ষা জীবন: ইমাম আবু হানীফা (রহ) জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যবসায়ী কর্মে আত্মনিয়োগ করেন, শিক্ষা দিক্ষায় মনোনিবেশ হননি। ইমাম শা’আবী (রহ) এর সাথে সাক্ষাত ঘটলে তাঁর পরামর্শে তিনি শিক্ষামুখী হন। ইমাম আবু হানীফা নিজেই বলেন, আমি একদিন ইমাম শা’আবীর পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম , তখন তিনি আমাকে ডাকলেন এবং বললেন, তুমি কার কাছে যাচ্ছ ? আমি তাকে উস্তায সম্বোধন করে বললাম যে, আমি বাজারে যাচ্ছি। ইমাম শা’আবী (রহ) বললেন, তোমার বাজারে যাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করিনি, আমি জিজ্ঞেস করলাম কোন আলিমের কাছে যাচ্ছ ? জবাবে ইমাম আবু হানীফা (রহ) বললেন, “আসলে আলিমদের সাতে আমার যোগাযোগ খুবই কম।‘ ইমাম শা’আবী (রহ) বললেন, না তুমি এরুপ করো না, বরং তুমি শিক্ষামুখী হও এবং আলিমদের সাথে উঠাবসা শুরু কর, কারণ আমি তোমার মাঝে ভালো আলামত দেখছি। ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেন, ইমাম শা’আবী’র এই উপদেশ আমার হৃদয়ে রেখাপাত করলো ফলে আমি বাজার যাওয়া বন্ধ করলাম এবং জ্ঞান গবেষণামুখী হলাম। আল্লাহ তাআলা তাঁর উপদেশের মাধ্যমে আমাকে উপকৃত করেছেন।
এভাবেই আবু হানীফা (রহ) শিক্ষা জীবন শুরু করেন। শিক্ষা জীবন শুরু করে তিনি কালাম শাস্ত্র ও তর্কবিদ্যা শিক্ষালাভ করে ভ্রান্ত মতবাদের প্রতিবাদে তর্ক সংগ্রাম চালিয়ে তার্কিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। কিন্তু এ তর্ক চর্চা কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ শাস্ত্রের বিঘ্নতা সৃষ্টি করলে তর্ক চর্চ্চা বর্জন করে কুরআন, সুন্নাহ ও ফিকহ চর্চ্চায় মনোনিবেশ করেন।
ইমাম আবূ হানীফার (রহ) শিক্ষকবৃন্দ:
ইমাম আবু হানীফা (রহ) কোন সাহাবীর দেখা সাক্ষাত পেয়েছেন কিনা তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে। তিনি ছোট বয়সে দু’একজন সাহাবীর সাক্ষাত লাভ করেন বলে জীবন লেখকরা উল্লেখ করেছেন যেমন আনাস বিন মালিক (রা) কিন্তু তাদের কাছ থেকে তেমন কিছু শিক্ষা গ্রহণ করতে পারেন নি, কারণ তিনি প্রাথমিক যুগে ব্যবসায়ী কর্মে নিয়োজিত ছিলেন, অত:পর ইমাম শাআবী’র অনুপ্রেরণায় দ্বীন শিক্ষায় আত্মনিয়োগ করেন। ইমাম আল মিযযী (রহ) ইমাম আবু হানীফা (রহ) যাদের কাছে শিক্ষালাভ করেছেন তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোট ৫০ জন শাইখ এর নাম উল্লেখ করেন।
তাদের মধ্যে প্রসিদ্ধ কয়েকজনের নাম উল্লেখ করা হলো:
1. যায়িদ বিন আলী আল হাশেমী (রহ)
2. আদী বিন ছাবিহত আল-আনসারী (রহ)
3. আবদুল মালিক বিন আবিল মাখারিক আল মাসরী (রহ)
4. মুহাম্মাদ বিন আলী আল হাশেমী (রহ)
5. আবদুল মালিক বিন আবিল মাখারিক আল-মাসরী (রহ)
6. হাম্মাদ বিন আবী সুলাইমান আল-আশয়ারী (রহ)
ইমাম আবু হানীফার (রহ) ছাত্রবৃন্দ:
1. জারীর বিন আব্দুল হামীদ আল কুফী (রহ)
2. হাম্মাদ বিন আবী হানীফাহ আল কুফী (রহ)
3. ইমাম আবদুল্লাহ বিন মুবারক আল হানযালী (রহ)
4. ইমাম মুহাম্মদ বিন হাসান আশশায়বানী (রহ)
5. ইমাম ইয়াকুব বিন ইবরাহীম আবূ ইউসূফ আল কাযী (রহ)
6. ইমাম নূহ বিন আবী মারয়াম আল মারওয়াযী (রহ) প্রমুখ।
ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ):
ফিকহ শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ)- এর অবস্থান ও অবদান সম্পর্কে বলার অপেক্ষা রাখেনা, কারণ তিনি ফিকাহ শাস্ত্রের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ইমাম সাহেবের অন্যতম ছাত্র ইমাম আবদুল্লাহ ইবনু মুবারক (রহ) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহ) স্বীয় যুগে ফিকহ শাস্ত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বি ব্যক্তি ছিলেন। তিনি সমযুগে প্রসিদ্ধ তাবেঈ যেমন আত্বা বিন রাবাহ, নাফি, মাওলা ইবনু উমার ও কাতাদাহ প্রভৃতি তাবেঈদের (রহ) হতে ফিকহ শাস্ত্রে পান্ডিত্য অর্জন করেন। তবে ফিকহ শাস্ত্রের উপর ইমাম সাহেবের উল্লেখযোগ্য কোন রচিত গ্রন্থ পাওয়া যায় না।
হাদীস শাস্ত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ):
ইমাম আবু হানীফা (রহ) একশত হিজরীর পরে অর্থ্যাত তাঁর বিছর বছর বয়সের পর তিনি হাদীস শিক্ষায় মনোনিবেশ করেন এবং অনেক প্রসিদ্ধ আলিম হতে শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু হাদীস বর্ণনার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকা খুবই নগণ্য।
এর দুটি কারণ হতে পারে:
প্রথম কারণ: তিনি হাদীস বর্ণনায় কঠোরতা অবলম্বন করতেন। ইমাম ইবনু সালাহ (রহ) বলেন:
“হাদীস বর্ণনায একশ্রেণীর মানুষ কঠোরতা অবলম্বন করে সীমালঙ্ঘন করেছেন, আবার আরেক শ্রেণী শিথিলতা অবলম্বন করে সীমালঙ্ঘন করেছেন। কঠোরতার মধ্যে হলো, যারা মনে করেন যে, বর্ণনাকারীর শুধু মুখস্ত বর্ণিত হাদীস ছাড়া অন্য হাদীস দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না, ইহা মালিক ও ইমাম আবু হানীফার মত।
দ্বিতীয় কারণ:
ইমামের হাদীস বর্ণনা কম হওয়ার অপর কারণ হলো তিনি মাসআল-মাসায়েলের গবেষণায় বেশী ব্যস্ত থাকতেন। হাদীস বর্ণনার সুযোগ হত না।
উকূদুল জিমান গ্রন্থের লেখক বলেন,
‘ইমাম সাহেবের বিভিন্ন দলীলের মাসআলার গবেষণায় ব্যস্ততার দরুন হাদীস বর্ণনা কমে গেছে, যেমন-প্রসিদ্ধ সাহাবী আবু বাকর, উমার(রা) সহ অনেকেই প্রচুর জানা-শুনা থাকা সত্বেও বিভিন্ন কাজে ব্যস্ততার দরুন হাদীস বর্ণনা করতে পারেন নি।
ইমাম আবু হানীফার গ্রন্থ:
ঈমাম আবু হানীফার রচিত তেমন কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। ইতিহাসবিদগণ কিছূ গ্রন্থ তাঁর রচিত গ্রন্থ বলে প্রসিদ্ধ। এগুলোর মধ্যে আল ফিক্বহুল আকবার, মুসনাদে আবী হানীফাহ,ক্বিতাবুল রাদ আলাল ক্বাদরীয়া,কিতাবুল ওসিয়ত,রিসালাতুল ইমাম আবী হানীফা, আল-আলেম ওয়াল মুতা’আল্লিম প্রভৃতি।
কোন কোন মুহাদ্দিস বলেছেন ওগুলো ইমাম সাহেবের সংকলন নয় বরং তাঁর অনেক পরি সেগুলি সংকলন করে তাঁর নামে দেয়া হয়েছে। আল্লামা শাহ আব্দুল আযীয দেহলভী হানাফী (রহ) বলেন, বরং সে গ্রন্থগুলো অনেক পরে বিভিন্নজন সংকলন করেন।
ইমাম ইবনু হাজার আসকালানী (রহ) বলেন, অনুরুপ মুসনাদ আবী হানীফাহ ধারণা করা হয ইমাম আবু হানীফার সংকলন, আসলে তা নয়।
অতএব বলা যেতে পারে যে, ইমাম আবু হানীফার (রহ) নামে যে গ্রন্থগুলো উল্লেখ করা হয় সেগুলি হয়তোবা ইমাম আবু হানীফা হতে তাঁর ছাত্ররা শিক্ষালাভের পর যে হাদীসগুলি সংকলন করে তাঁর নামে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহই সর্বাধিক অবগত।
কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণে ইমাম আবু হানীফার তাগিদ:
ইমাম আবু হানীফা কুরআন ও সুন্নাহর অনুসরণ নিজেও করেছেন সেই সাথে আমাদেরকেও কুরআন ও সহীহ সুন্নাহর অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়ে গেছেন।
ইমাম আবু হানীফা (রহ) বলেন,
‘কোন বিষয়ে যখন সহীহ হাদীস পাওয়া যাবে, জেনে রেখ সেটাই আমার মাযহাব বা মত ও পথ।
‘ আমি যদি এমন কথা বলি যা আল্লাহ তা’আলার কিতাব ও রাসূলের হাদীসের বিপরীত হয়, তখন আমার কথাকে বর্জন কর।
‘যে ব্যক্তি আমার দলীল অবগত নয়, তার পক্ষে আমার কথা অনুযায়ী ফাতওয়া দেয়া সম্পূর্ণ হারাম।
তিনি স্বীয় শিষ্য ইয়াকুব ইমাম আবূ ইউসূফকে বলেন, সাবধান তুমি আমার কাছে যা কিছুই শুনো, সবই লিখ না, কারণ আমি আজ এক সিদ্ধান্ত দেই, আবার আগামীকাল তা প্রত্যাখ্যান করি। আবার আগামীকাল এক ফাতওয়া বা সিদ্ধান্ত নেই, তার পরের দিন তা প্রত্যাখ্যান করি।
ইমাম আবু হানীফা সম্পর্কে আলিম সমাজের উক্তি:
ইমাম আবু হানীফা (রহ)-এর ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্য বর্ণনায় অনেকেই প্রশংসা করেছেন,
যেমন-
ইমাম আহমাদ বিন হাম্বল (রহ) বলেন, ইমাম সাহেব শিক্ষা, আল্লাহভীরুতা ও আখিরাতমুখী হিসেবে এক বিশেষ অবস্থানে ছিলেন। আবু জাফর আল মানসুরের কাজী বা ব্চিারকের পদ গ্রহণের জন্য তাঁকে প্রহার করা হয়েছে তবুও তিনি তা গ্রহণ করেন নি। আল্লাহ তাকে বিশেষ রহম করুন।
ইমাম ইবনু তাইমিয়াহ (রহ) বলেন, যদিও মানুষেরা ইমাম আবু হানীফার কিছু বিষয়ে বিরোধিতা করেছেন এবং অপছন্দ করেছেন,কিন্তু তারঁ জ্ঞান ও বিবেক-বুদ্ধিতে কারো কোনরুপ সন্দেহ নেই।
ইমাম যাহাবী (রহ) বলেন, ইমাম আবু হানীফা (রহ) একজন বিশিষ্ট আলিম, গবেষক,সাধক ও ইমাম ছিলেন। তিনি বড় ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারী ছিলেন, রাজ-বাদশাহদের কোন পুরষ্কার গ্রহণ করতেন না।
ইমামের মৃত্যুবরণ: মহান ব্যক্তিত্বের অধিকারী ইমাম আবু হানীফা (রহ) ১৫ই শাবান ১৫০ হিজরী,৭০ বছর বয়স পরপারে পাড়ি জমান এবং বাগদাদের গোরস্থানে তাকে দাফন করা হয়। আল্লাহ তাকে রহম করুন এবং জান্নাতুল ফিরদাউসে স্থান দান করুন । আমীন!
বিশেষ দ্রষ্টব্য:
জীবনী সংক্রান্ত তথ্যগুলো সুন্নাতে রাসুল (সা) ও চার ইমামের অবস্থান, সিফাতু সালাতিন নাবী (শায়খ আলবানী
রচিত),সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা, উইকিপিডিয়া, সীরাতে নোমান, হানাফী ফিকহের বৈশিস্ট্য প্রভৃতি থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।
No comments:
Post a Comment