Friday, June 19, 2015

আসুন সহীহভাবে জেনে নিই সিয়ামের বিধি-বিধান

আসুন সহীহভাবে জেনে নিই সিয়ামের বিধি-বিধান ———
———— পর্বঃ— রমযানের সিয়ামে মানুষের শ্রেণীভেদ ————
~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
রমজান মাসে সিয়ামের হুকুম ঃ—
———————————
রমযানের সিয়াম নারী-পুরুষ প্রত্যেক মুসলিম, বালেগ, বিবেকবান, সিয়াম পালন করতে সক্ষম, বাড়িতে অবস্থানকারী, নিষিদ্ধতা থেকে মুক্ত (যেমনঃ মাসিক ঋতু বা প্রসূতির রক্ত যা মহিলাদের জন্য নির্দিষ্ট) ব্যক্তির উপর ফরয।
আল্লাহ তা’আলা সিয়াম পালন এ উম্মতের উপর ফরয করে দিয়েছেন যেমনটি ফরয করেছিলেন আগের উম্মতের উপর।
আল্লাহর বাণীঃ
“হে মুমিনগণ, তোমাদের উপর সিয়াম ফরয করা হয়েছে, যেভাবে ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর। যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন কর।” (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৩)
“রমযান মাস, যাতে কুরআন নাযিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হিদায়াতস্বরূপ এবং হিদায়াতের সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী ও সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারীরূপে। সুতরাং তোমাদের মধ্যে যে মাসটিতে উপস্থিত হবে, সে যেন তাতে সিয়াম পালন করে......।” (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৫)
**********
১। সলাত ত্যাগকারী ব্যক্তির সিয়াম ঃ—
——————————————
যে ব্যক্তি ৫ ওয়াক্ত সলাত ফরয হওয়ার কথা অস্বীকার করে এবং ইচ্ছাকৃত তা ত্যাগ করে সে ব্যক্তি উলামাদের সর্বসম্মতিক্রমে কাফের। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি অবহেলায় অলসতার দরুন সলাত ত্যাগ করে, সে ব্যক্তিও উলামাদের শুদ্ধ মতানুসারে কাফের কারণ রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “মানুষ এবং কুফর ও শির্কের মাঝে (অন্তরাল) সলাত ত্যাগ।” (সহীহ মুসলিম)
তিনি আরও বলেন, “আমাদের মাঝে ও তাদের মাঝে চুক্তিই হলো সলাত; যে ব্যক্তি তা পরিত্যাগ করে সে কাফের।” (তিরমিযী, ইবনু মাজাহ, আহমাদ, হাকেম)
এখানে কাফের বলতে বা কুফর বলতে সেই কুফরকে বুঝানো হয়েছে, যা মানুষকে ইসলাম থেকে খারিজ করে দেয়, যেহেতু আল্লাহর রসূল সলাতকে মুমিন ও কাফেরদের মাঝে অন্তরাল বলে চিহ্নিত করেছেন। কাজেই, যে ব্যক্তি কাফের প্রতীয়মান হবে, সে ব্যক্তির সিয়াম ও সকল প্রকার ইবাদাত পণ্ড হয়ে যাবে। কারণ, মহান আল্লাহ বলেন, “তারা যদি শির্ক করত, তাহলে তাদের কৃতকর্ম পণ্ড হয়ে যেত।” (সূরা আন’আমঃ আয়াত ৮৮)
কাজেই কোনো বেনামাযি যতক্ষণ পর্যন্ত তওবা করে ৫ ওয়াক্ত ফরয সলাত কায়েমের দিকে ফিরে না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁর সিয়াম ও অন্যান্য ইবাদাত কবুল হবেনা যেহেতু আল্লাহর রসূল বলেছেন, “মানুষ এবং কুফর ও শির্কের মাঝে (অন্তরাল) সলাত ত্যাগ।”
তবে বেনামাযি সিয়াম ছাড়তে আদিষ্ট বা উপদিষ্ট নয় কারণ হতে পারে সিয়ামের মাধ্যমে তাঁর অন্তর আল্লাহর দিকে ধাবিত হবে এবং এতে করে সে হয়ত তওবা করে সারা বছরই ৫ ওয়াক্ত সলাত কায়েমের দিকে ফিরে আসবে।
**********
২। অক্ষম ব্যক্তির সিয়াম ঃ—
——————————
বৃদ্ধ ও স্থবির বা অথর্ব ব্যক্তি যার শারীরিক ক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে গেছে এবং দিনের দিন আরও খারাপের দিকে যেতে যেতে মরণের দিকে অগ্রসর হতে চলেছে, সে ব্যক্তির জন্য সিয়াম ফরয নয়। কষ্ট হলে সে সিয়াম রাখবে না। মহান আল্লাহ বলেন, “আর যাদের জন্য তা (রমযানের সিয়াম) কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদয়া- একজন মিসকিনকে খাবার প্রদান করা।” (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৪)
ইবনে আব্বাস (রদ্বী-আল্লাহু ’আনহু) বলতেন, এই আয়াত মানসূখ নয়। তারা হলো অথর্ব বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, যারা সিয়াম পালনে সক্ষম নয়। তারা প্রত্যেক দিনের বদলে একটি করে মিসকীনকে খাদ্য দান করবে। (বুখারী)
অবশ্য এমন বৃদ্ধ, যার কোনো জ্ঞানই নেই, তার জন্য এবং তার পরিবারের জন্য কোনকিছুই ফরয নয়। তার তরফ থেকে সিয়াম পালন করতে হবে না বা কাযা করতে হবে না এবং মিসকীনও খাওয়াতে হবে না। কারণ, শরীয়তের সকল ভার তার পক্ষে মাফ হয়ে গেছে। কিন্তু সে যদি এমন বৃদ্ধ হয়, যে কখনো কখনো ভালো-মন্দের তমীয-জ্ঞান করতে পারে, আবার কখনো কখনো আবোল-তাবোল বকে, তাহলে যে সময় সে ভালো থাকে সেই সময় তার জন্য সিয়াম বা খাদ্যদান ফরয এবং যে সময় তমীয-জ্ঞান থাকে না সে সময় ফরয নয় (মাস'আলাহ ফিস সিয়াম)।
এমন চিররোগা, যার রোগ ভালো হওয়ার কোন আশা নেই; যেমন ক্যান্সারের রোগী (পেট খালি রাখলে পেটে যন্ত্রণা হয়) এমন রোগা ব্যক্তির জন্য সিয়াম ফরয নয়। কারণ, তার এমন কোনো সময় নেই, যে সময়ে সে তা রাখতে পারে। অতএব তার তরফ থেকে একটি সিয়ামের পরিবর্তে একটি করে মিসকীন খাওয়াতে হবে (ইবনে উসায়মিন, ফুসিতাযা)।

অক্ষম ব্যক্তির সিয়ামের পরিবর্তে খাদ্য দানের নিয়ম ঃ—
—————————————————————
মিসকীনকে খাদ্যদানের ২টি নিয়ম আছে।
প্রথম নিয়ম এই যে, একদিন খাবার তৈরি করে সিয়ামের সংখ্যা হিসেবে মিসকীন খাইয়ে দেবে অথবা একজন মিসকীনকেই ঐ পরিমাণ দিন খাইয়ে দেবে।
আনাস (রদ্বী-আল্লাহু 'আনহু) বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাই করতেন। তিনি এক অথবা দুই বছর সিয়াম পালন করতে না পারলে প্রত্যহ মিসকীনকে গোশত-রুটি খাইয়েছেন। (বুখারী)
দ্বিতীয় নিয়ম এই যে, অপক্ক খাদ্য দান করবে। অর্থাৎ, দেশের প্রধান খাদ্য থেকে প্রত্যেক দিনের পরিবর্তে প্রত্যেক মিসকীনকে মোটামুটি সোয়া এক কিলো করে খাদ্য (চাল অথবা গম) দান করবে। যেহেতু কা’ব বিন উজরার ইহরাম অবস্থায় মাথায় উকুন হলে আল্লাহর রসূল তাকে বলেন, “তোমার মাথা মুণ্ডন করে ফেল এবং তিনদিন সিয়াম পালন করো, কিংবা প্রত্যেক মিসকীনকে মাথাপিছু অর্ধ সা’ (মোটামুটি সোয়া এক কিলো) করে ছয়টি মিসকীনকে খাদ্য দান করো, কিংবা একটি ছাগ কুরবানি করো।” (বুখারী-মুসলিম)
খাদ্য দান কখন করবে সে বিষয়ে এখতিয়ার আছে। যদি প্রত্যেকদিন একটা করে সিয়ামের ফিদয়া দান করে, তাও চলবে। যদি মাসের শেষে সব দিনগুলো হিসাব করে একই দিনে তা দান করে, তাও চলবে। এ ব্যাপারে বাধ্য-বাধকতা কিছু নেই। তবে সিয়ামের আগে দেওয়া চলবে না। কারণ, তা আগে সিয়াম পালনের মতো হয়ে যাবে। আর রমজানের আগে শাবানে কি ফরয সিয়াম পালন করা চলবে? (আশশারহুল মুমতে)
সমস্ত খাদ্যকে সিয়ামের সংখ্যা পরিমাণ মিসকীনের মাঝে বণ্টন করা যাবে। যেমন সমস্ত খাদ্য কেবল উপযুক্ত একজন মিসকীন অথবা একটি মাত্র মিসকীন পরিবারকেও দেওয়া যাবে (ইবনে জিবরীন, ফাসিঃ জিরাইসী)।
**********
৩। যে ব্যক্তির রোগ সাময়িক ঃ—
———————————
যে ব্যক্তির রোগ সাময়িক, যা সেরে যাওয়ার আশা আছে, যেমন জ্বর ইত্যাদি, এমন ব্যক্তির ৩ অবস্থা হতে পারে ঃ-
১। সিয়াম পালন করলে তার কোনো ক্ষতি করবে না। এমতাবস্থায় তার সিয়াম পালন করা ওয়াজিব। কারণ, তার কোনো ওজর নেই।
২। সিয়াম পালন করলে তার কষ্ট হবে, তবে সিয়াম তার কোনো ক্ষতি করবে না। এমন অবস্থায় তার জন্য সিয়াম পালন করা মাকরুহ। কারণ, তাতে আল্লাহর দেওয়া অনুমতি ও তার আত্মার প্রতি দয়া প্রদর্শন করা থেকে ভিন্ন আচরণ হয়ে যায়। অথচ মহান আল্লাহ বলেন, “কিন্তু তোমাদের মাঝে কেউ অসুস্থ বা মুসাফির হলে সে অপর কোনো দিন গণনা করবে।”
(সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৪)
৩। সিয়াম পালন করলে সিয়াম তার ক্ষতি করবে (রোগ বৃদ্ধি করবে বা কোনো বড় রোগ আনয়ন করবে বা তার অবস্থা মরণাপন্ন হয়ে যাবে)। এমতাবস্থায় তার জন্য সিয়াম পালন করা হারাম। কেননা, নিজের উপর ক্ষতি ডেকে আনা বৈধ নয়। মহান আল্লাহ বলেনঃ- “তোমরা আত্মহত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি দয়াশীল।” (সূরা নিসাঃ আয়াত ২৯)
তিনি আরও বলেনঃ- “তোমরা নিজদেরকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিও না।” (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৯৫)
রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেনঃ- “কেউ নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হবে না এবং অপরেরও ক্ষতি করবে না।” (আহমাদ, ইবনু মাজাহ, হাকেম, বায়হাকী, সিলসিলাহ সহীহাহ, আলবানী)
সিয়াম রোগীকে ক্ষতি করছে কিনা তা জানা যাবে সিয়াম পালনকারীর নিজে ক্ষতি অনুভব করার মাধ্যমে অথবা বিশ্বস্ত কোনো ডাক্তারের ফয়সালা অনুযায়ী।
এই শ্রেণীর রোগী যে দিনের সিয়াম ত্যাগ করবে, সেই দিনের সিয়াম পরবর্তীতে সুস্থ হলে অবশ্যই কাযা করবে। আর এমন রোগীর তরফ থেকে মিসকীনকে খাদ্যদান যথেষ্ট নয়। (আশশাহরুল মুমতে)
শেষোক্ত প্রকার কোনো রোগী যদি কষ্ট করে ও ক্ষতি স্বীকার করেও সিয়াম পালন করে, তাহলে তার সিয়াম শুদ্ধ হবে না। বরং তাকে সুস্থ অবস্থায় কাযা করতে হবে। (মুহাল্লা ইবনে হাযম) কারণ, ঐ সময় তার জন্য সিয়াম নিষিদ্ধ; যা রাখা বৈধ নয় এবং রাখলেও শুদ্ধ নয়।
**********
৪। সফর অবস্থায় সিয়ামের বিধান ঃ—
——————————————
সফর অবস্থায় রমজানের সিয়াম না রেখে পরে তা কাজা করা বৈধ। মহান আল্লাহ বলেনঃ- “কিন্তু তোমাদের মধ্যে কেউ অসুস্থ বা মুসাফির হলে সে অপর কোনো দিন গণনা করবে।” (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৪)
সফর অবস্থায় সিয়াম পালন করা বা কাজা করার মধ্যে যেটা তার জন্য সহজ ও সুবিধা হবে, সেটাই সে করবে। মহান আল্লাহ বলেন, “আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান এবং তিনি তোমাদের জন্য কঠিন কিছু চান না”। (সূরা বাক্বারাহঃ আয়াত ১৮৫)
হামযাহ বিন আমর আসলামী রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-কে সফরে সিয়াম পালন করা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করলে উত্তরে তিনি বলেন, “তোমার ইচ্ছা হলে তুমি সিয়াম পালন করো, আর ইচ্ছা না হলে সিয়াম পালন করোনা।” (বুখারী-মুসলিম)
তবে সাধারণভাবে মুসাফিরের জন্য সফর অবস্থায় সিয়াম পালন না করাই উত্তম। আর রমযানে মুসাফিরের সিয়াম রাখা ও না রাখা যদি বরাবর হয় তাহলে রাখাই উত্তম। আর সফর অবস্থায় সিয়াম যদি কষ্টকর হয় তবে না রাখাই উত্তম এবং পরে কাজা করে নেবে। একইভাবে সিয়াম যদি কঠিন কষ্ট হয়, তাহলে না রাখাই ওয়াজিব এবং পরে কাজা করে নেবে।
আনাস ইবনে মালেক (রদ্বী-আল্লাহু 'আনহু) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ- “আমরা রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর সঙ্গে সফরে ছিলাম। রোজাদার বেরোজাদারকে এবং বেরোজাদার রোজাদারকে কোনো প্রকার দোষারোপ করেন নাই।” (বুখারী-মুসলিম)
তবে সফরটি অবশ্যই সফর পরিমাণ দূরত্ব হতে হবে। অর্থাৎ এমন সফর হতে হবে, যাকে পরিভাষায় সফর বলা হয়। আর এর সঠিক মত এই যে, সফর চিহ্নিত করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট মাপের দূরত্ব নেই। এ ব্যাপারে প্রচলিত অর্থ ও পরিভাষার সাহায্য নিতে হবে। যেমন উদাহরণস্বরূপ- ঢাকা থেকে খুলনা অথবা চটগ্রাম থেকে কুষ্টিয়া হলো সফর। কিন্তু মিরপুর থেকে মতিজিল বা নীলক্ষেত থেকে গুলশান সেই সফরের আওতায় পড়ে না।
সিয়াম অবস্থায় স্বামী-স্ত্রী একসাথে সফর করে সফরে দিনের বেলায় সঙ্গমে লিপ্ত হয়ে পড়লে কোনো ক্ষতি নেই। কারণ, মুসাফিরের জন্য সিয়াম ভাঙ্গা বৈধ। অতএব, সে কিছু খেয়ে, অথবা পান করে অথবা সঙ্গম করে সিয়াম ভাঙ্গতে পারে। এসব কিছুই তার জন্য হালাল। বলা বাহুল্য, ঐ সিয়াম কাজা করা ছাড়া তার জন্য অন্য কিছু ওয়াজিব নয়। (আশশারহুল মুমতে)
**********
৫। ঋতুবতী, প্রসূতি, ও গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারিণী নারীর সিয়ামের বিধান ঃ—
——————————————————————————
ঋতুবতী ও প্রসূতি নারীর সিয়াম পালন করা হারাম। তারা সিয়াম ভাঙ্গবে এবং পরে কাজা করে নেবে। আর যদি ঋতুবতী ও প্রসূতি দিনের মাঝে পবিত্র হয়ে যায় অথবা মুসাফির দিনের বেলা বাড়িতে পৌঁছে তবে বাকি দিন না খেয়ে থাকা জরুরী নয়। কিন্তু পরে কাজা করা অবশ্যই জরুরী।
একইভাবে গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারিণী নারী যদি নিজের বা বাচ্চার উপর ভয় করে তাহলে রমজানের সিয়াম ছেড়ে দেবে ও পরে কাজা করে নেবে। কেননা আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ- “আল্লাহ মুসাফিরের উপর থেকে (যথাসময়ে) সিয়াম এবং অর্ধেক সলাত, আর গর্ভবতী ও দুগ্ধধাত্রী মহিলার উপর থেকে (যথাসময়ে) সিয়াম লাঘব করেছেন।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী, নাসায়ী, সহীহুল জামে, আলবানী)
এই হাদিসের উদ্দেশ্য এই যে, তারা রমযানে সিয়াম না রেখে সময়মত কাজা করতে পারে। কিন্তু সিয়াম একেবারেই মাফ নয়। বলা বাহুল্য, গর্ভবতী বা স্তন্যদানকারিণী যদি নিজের বা বাচ্চার উপর ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা মোটেই না থাকে তাহলে রমজানে সিয়াম ভাঙ্গা বৈধ নয়।
ঋতুবতী, প্রসূতি, গর্ভবতী, ও স্তন্যদানকারিনী - সকলকেই কাজা সিয়ামগুলো পরবর্তী রমজান আসার পূর্বেই রাখতে হবে। তার মানে পরবর্তী শাবান মাসের ভেতরেই সব শেষ করতে হবে। আর এটাই আয়েশা (রদ্বী-আল্লাহু 'আনহা) বর্ণিত হাদিস থেকে প্রমানীত।
এদের সকলের জন্যই সিয়াম কাজা করা ওয়াজিব, তবে ফিদয়া দেওয়া ওয়াজিব নয়।
তবে যদি এমন কোনো মহিলা হয় যে প্রতি দুই-আড়াই বছর পরপর সন্তান ধারণ করে, তাহলে তার জন্য সিয়াম কাজা না করে উপরে বর্ণিত অক্ষম ব্যক্তির মতই অর্ধ সা পরিমাণ ফিদয়া দেয়াই ওয়াজিব, যেহেতু সে সিয়াম কাজা করার কোনো সুযোগই পাচ্ছে না। যেকোন সময় হয় সে গর্ভবতী থাকবে নচেৎ দুগ্ধদায়িনী। আর গর্ভ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তার সিয়াম পালন করার সুযোগই হয়ে উঠবে না। অতএব সে সিয়ামের পরিবর্তে মিসকীনকে খানা খাইয়ে দেবে।
**********
৬। শিশু ঃ—
————
নাবালক ছোট শিশুর জন্য সিয়াম ফরয নয়। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ- “তিন ব্যক্তির নিকট থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে- জ্ঞানশূন্য পাগলের নিকট থেকে; যতক্ষণ না সে সুস্থ হয়েছে। ঘুমন্ত ব্যক্তির নিকট থেকে; যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়েছে। আর শিশুর নিকট থেকে; যতক্ষণ না সে সাবালক হয়েছে।” (আহমাদ, আবু দাউদ, তিরমিযী)
অবশ্য জ্ঞানবান শিশু সিয়াম পালন করলে তা শুদ্ধ হবে এবং সওয়াবও পাবে। আর তার পিতামাতার জন্যও রয়েছে তরবিয়ত ও ভালো কাজের নির্দেশ দেওয়ার সওয়াব।
সুতরাং অভিভাবকদের উচিত, সিয়াম পালনে সক্ষম ছোট শিশুদেরকে সিয়াম পালনে আদেশ করা, উৎসাহ দিয়ে তাদেরকে এই বিরাট ইবাদাতে অভ্যাসী করা এবং তার জন্য উদ্বুদ্ধকারী পুরস্কার ও উপহার নির্ধারিত করা। রসূলুল্লাহ (সল্লাল্লাহু ’আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবাগণ নিজ নিজ ছোট বাচ্চাদেরকে সিয়াম পালনে আদেশ দিতেন। রুবাইয়ে’ বিনতে মুআওবিজ (রদ্বী-আল্লাহু ’আনহু) বলেন, আশূরার সকালে আল্লাহর রসূল (সল্লাল্লাহু 'আলাইহি ওয়া সাল্লাম) মদিনার উপকণ্ঠে অবস্থিত আনসারদের মহল্লায় বলে পাঠালেন যে, “যে ব্যক্তি ফজরের আগে থেকেই সিয়াম রেখেছে, সে যেন তার সিয়াম পূর্ণ করে। আর যে ব্যক্তির সিয়াম না রেখে ফজর হয়েছে, সেও যেন বাকী দিন সিয়াম থাকে।”
সুতরাং আমরা তারপর থেকে সিয়াম পালন করতাম। আমাদের ছোট শিশুদেরকে -আল্লাহর ইচ্ছায় - সিয়াম পালন করাতাম এবং তাদেরকে নিয়ে মসজিদে যেতাম। তাদের জন্য তুলো দিয়ে পুতুল গড়াতাম। তাদের কেউ খাবারের জন্য কাঁদতে লাগলে তাকে ঐ পুতুল দিতাম। আর এইভাবে ইফতারের সময় হয়ে যেত। অন্য এক বর্ণনায় আছে, আমরা তাদেরকে ঐ খেলনা দিতাম, যাতে তারা ভুলে থাকে এবং খেলার ঘোরে তাদের সিয়াম পূর্ণ করতে পারে।” (সহীহ মুসলিম)
শিশু (স্বপ্নদোষ হয়ে) দিনের মধ্যে সাবালক হলে দিনের বাকী অংশ সিয়াম নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকবে। কারণ, এক্ষেত্রে তার জন্য সিয়াম ফরয। অবশ্য এর পূর্বের সিয়ামগুলো কাজা করতে হবে না কারণ পূর্বে তার উপর সিয়াম ফরয ছিল না। (মাস'আলা ফিস-সিয়াম)
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্যে যে, তিনটির মধ্যে একটি লক্ষণ দেখে সাবালক চেনা যায়ঃ- স্বপ্নদোষ বা অন্য প্রকারে সকাম বীর্যপাত হওয়া, নাভীর নিচে মোটা লোম গজানো, অথবা ১৫ বছর বয়স হওয়া।
আর বালিকাদের ক্ষেত্রে একটি অধিক লক্ষণ হলো, মাসিক শুরু হওয়া। বলা বাহুল্য, বালিকার মাসিক খুন আসতে শুরু হলেই সে সাবালিকা; যদিও তার বয়স ১০ বছর বা তার কম হয়।
**********
৭। পাগল ঃ—
————
পাগলের উপর সিয়াম ফরয নয়। কারণ, তার উপর থেকে কলম উঠিয়ে নেয়া হয়েছে যেটি উপরে হাদিসে উল্লেখ করা হয়েছে। অনুরূপ আধা পাগলা, যার ভালো-মন্দের তামীয নেই এবং অনুরূপ স্থবির বৃদ্ধ, যার তমীয-জ্ঞান নষ্ট হয়ে গেছে। এ সকল জ্ঞানহীন মানুষদের তরফ থেকে খাদ্যদানও ওয়াজিব নয়।
পাগল দিনের মধ্যে সুস্থ হলে তার জন্য দিনের বাকী অংশ সিয়াম নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকা জরুরী। কারণ, এক্ষণে তার জন্য সিয়াম ফরয। অবশ্য এর পূর্বের সিয়ামগুলোর জন্য কাজা করতে হবে না। কেননা, পূর্বে তার উপর সিয়াম ফরয ছিল না।
পাগল যদি এমন হয় যে, ক্ষণে পাগল ক্ষণে ভালো, তাহলে এমন ব্যক্তির জন্য ভালো থাকা অবস্থায় সিয়াম নষ্টকারী জিনিস থেকে বিরত থাকা জরুরী। আর পাগল থাকা অবস্থায় তা ধর্তব্য নয়। পক্ষান্তরে ভালো থাকা অবস্থায় সিয়াম রেখে দিনে হঠাৎ পাগল হয়ে গেলে তার সিয়াম বাতিল নয়। যেমন কেউ যদি কোনো রোগ বা আঘাত ইত্যাদির কারণে বেহুঁশ বা অজ্ঞান হয়ে যায় তাহলে তার সিয়ামও নষ্ট হয় না। কেননা, সে জ্ঞান থাকা অবস্থায় সিয়ামের নিয়ত করেছে, অতএব অজ্ঞান হলেও সে নিয়ত নষ্ট হবে না। এই বিধান মূর্ছা, হিষ্টিরিয়া বা জিন পাওয়া রোগীরও।
যদি কেউ সিয়াম থাকার ফলে (ক্ষুধার তাড়নায়) বেহুঁশ হয়ে যায়, তাহলে সে সিয়াম ভেঙ্গে কাজা করতে পারে। দিনের বেলায় কেউ বেহুঁশ হলে এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার আগে বা পরে হুঁশ ফিরে এলে তার সিয়াম শুদ্ধ। যেহেতু সে ভোরে ভালো অবস্থায় সিয়াম রেখেছে। অবশ্য কেউ যদি ফজর থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বেহুঁশ থাকে, তাহলে অধিকাংশ উলামাদের মতে তার সিয়াম শুদ্ধ নয়। এক্ষেত্রে অধিকাংশ উলামাদের মতে তাকে সে সিয়ামের কাজা করতে হবে, তাতে বেহুঁশ থাকার সময় যতই বেশি হোক না কেন। (সাবউনা মাসআলা ফিস সিয়াম, আশশারহুল মুমতে)
————————————
সোর্স সমূহ ঃ—
কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে ইসলামী ফিকাহ (by শাইখ ইবরাহীম আত-তুআইজিরী); রমজানের ফাজায়েল ও রোজার মাসায়েল (by শাইখ আব্দুল হামীদ ফাইযী মাদানী) এবং ইসলামিক সাইট।

No comments:

Post a Comment