কুর’আনের দিকে প্রত্যাবর্তন :
লেখকঃ মনসূর আহমেদ | অনুবাদকঃ মোহাম্মদ সলিমুল্লাহ
============================================
নিঃসন্দেহে কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্ক অনেক গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল আমারা বলতে গেলে তা ভুলে যাই।
আমাদের কুর’আনকে গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি আমার কাছে একটি তত্ত্বীয় ব্যাপার বলে মনে হয়। আর এক্ষেত্রে তত্ত্বটি হলঃ মানুষ স্বভাবতই বিতর্ক প্রিয়। পক্ষান্তরে, কুর’আনের জ্ঞান সমস্ত বিতর্কের ঊর্ধ্বে। ফলে যা হয় তা হল মানুষ বিতর্কহীন কুর’আনের প্রতি বেশী সময় ধরে আগ্রহ ধরে রাখতে পারেনা। কারণ, আগেই বলেছি, স্বভাবগতভাবেই মানুষ বিতর্ক করতে ভালবাসে।
ঈদের চাঁদ দেখা কিংবা কুরবানীর জবেহকৃত পশুর গোশত বণ্টন ইত্যাদি বিষয়গুলোর পক্ষে-বিপক্ষে আমরা বিতর্কে লিপ্ত হয়ে থাকি। কারণ এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলতে গেলে কিছুটা হলেও পুঁথিগত বিদ্যার প্রয়োজন যে বিদ্যা জাহির করে প্রতিপক্ষকে কুপোকাত করার একটা সুবর্ণ সুযোগ থাকে। আর প্রতিপক্ষের কুপোকাত হওয়াটা আমাদেরকে এক সস্তা মানসিক আত্মপ্রসাদ দান করে যা নিয়েই আমরা তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে থাকি। কুর’আনে কিন্তু এমন বিতর্ক নেই, কারণ বাস্তবে কি কেউ তাজবীদ (কুরআন তেলাওয়াতের নিয়ম-কানুন) বা কিরা’আত (কুর’আন তেলাওয়াতের শিল্প) এমন অতি ক্ষুদ্র বিষয়ে তর্ক করে?
আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন কুর’আন আল-কারীমে বলছেন যে নাবী মুহাম্মাদ (সা) তাঁর উম্মাহ্ তথা আমাদের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ করবেন। তিনি (সা) এই অভিযোগ করবেন না যে তাঁর (সা) উম্মাহ্ ৮ রাকা’আতের স্থলে ২০ রাকা’আত বা ১০ রাকা’আতের স্থলে ৮ রাকা’আত সলাত আদায় করেছে, বরং তাঁর (সা) অভিযোগ হবে এই যে তারা (আমরা) প্রতি ক্ষেত্রেই কুর’আনকে পরিত্যাগ করে আমাদের কাজকর্ম সম্পাদন করেছি।
“রাসূল (সা) বললেনঃ ‘হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায় এই কুর’আনকে পরিত্যাজ্য মনে করে।” [সূরা আল-ফুরকান; ২৫:৩০]
আসুন, বিষয়টি নিয়ে আরেকটু ভাবা যাক। কুর’আনের সাথে আমাদের সম্পর্ক কিসের? হৃদয়ের সর্বোচ্চ স্থানে না রেখে কুর’আনকে কি আমরা গৃহের দামী বুক শেলফের সর্বোচ্চ তাকে সাজিয়ে রেখেছি? তাকে কি আমরা সারাবছর তুলে রাখি শুধু রমজানে না বুঝে তেলাওয়াত করার জন্য? শুদ্ধ উচ্চারনে এবং তাজবীদ সহকারে কি কুর’আন পড়তে পারি আমরা? কখনো কি কুর’আন পড়ে বোঝার চেষ্টা করি এই অভ্রান্ত সত্যের কিতাব আমাদের কি করতে বলে? কেন আমাদের আত্মিক বা দৈনন্দিন জীবনে কুর’আনের কোনো প্রভাব পরিলক্ষিত হয় না?
প্রথমে যা বলছিলাম-আমরা বিতর্ক পছন্দ করি। কিন্তু প্রশ্ন হল, কেন বিতর্ক শুধু তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে যেখানে মাথা ঘামানোর মত আরো অনেক জটিল বিষয় পড়ে আছে? আর বিতর্ক যদি হয় ধর্মের কোন মৌলিক বিষয় নিয়ে তাহলে কেন আমরা কুর’আন থেকে সে বিষয়ের সমাধান পাওয়ার চেষ্টা করিনা? আল্লাহ্ রাব্বুল ‘আলামীন বলেনঃ
“এবং আল্লাহ্র রজ্জুকে মজবুতভাবে আঁকড়ে থাক আর কখনো বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” [সূরা আল-ইমরান; ৩:১০৩]
প্রসিদ্ধ তাফসীরসমূহ অনুসারে এ আয়াতে “আল্লাহ্র রজ্জু” হল কুর’আন আল-কারীম। কুর’আন আমাদেরকে সবসময়ই একটি বড় বিষয় মনে করিয়ে দেয়; আর তা হল “কিয়ামত”। কিন্তু কেন?
কেননা, তারাবীতে কত রাকা’আত সলাত আদায় করেছেন তার চেয়ে কিভাবে আদায় করেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। মসজিদে বৃহষ্পতি নাকি শুক্রবার ঈদ পালন করা হল সেটার চাইতে আগের একমাসে কেমন ইবাদত করেছেন সেটাই মুখ্য বিষয়। বিষয়টা আসলে আল্লাহ্, তাঁর কিতাব কুর’আন আল-কারীম এবং তাঁর প্রিয় নাবীর (সা) সাথে আমাদের হৃদয়ের টান, হৃদয়ের সম্পর্কের সাথে সংশ্লিষ্ট।
তবে এমনটি মনে করা মোটেই ঠিক হবেনা যে, কুর’আনের নির্ধারিত হুকুম-আহকামের তোয়াক্কা না করেই আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সাথে আত্মিক সম্পর্ক উন্নয়নের কাজে লেগে যাব। আর বাস্তবেও সেটা কখনই সম্ভব নয়। আমাদের উচিৎ হল সঠিক উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে এক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান ধরে থাকা। একবার এ ভারসাম্যে পৌছে গেলে তার স্বাভাবিক ফল হচ্ছে তখন কোন বিতর্কিত বিষয়গুলো মুসলিম উম্মাহ্র মাঝে কোন বিভেদ সৃষ্টিকারী প্রভাব ফেলতে পারবেনা।
লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ইসলামের মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে কখনই কোন বিতর্ক হয়না আর সেগুলো নিয়ে বিতর্ক করাও আমাদের কাজ নয়। তবে যে বিষয়গুলো নিয়ে বিতর্ক বা মতানৈক্য হয়ে থাকে সেগুলো যদি কোনভাবেও গুরুত্বপূর্ণ হয় তারপরও গৌণ বিষয়গুলোকে টেনে হিঁচড়ে এতোদূর নিয়ে যাওয়া মোটেই উচিৎ নয় যাতে করে মুসলিম উম্মাহ্র ঐক্য এবং ভ্রাতৃত্বের মতো মৌলিক বিষয়গুলো ঝুঁকির মধ্যে পড়ে।
No comments:
Post a Comment